গত ১৮ জুলাই। সকাল থেকেই সাভারের রেডিও কলোনী, বাজার বাসস্ট্যান্ড ও পাকিজার মোড়ে পুলিশের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাভার হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। নির্বিচারে গুলির পর পুলিশের সাঁজোয়া যানের ওপরে পড়ে থাকা মুমূর্ষু এক শিক্ষার্থীকে ঘুরানো হয়। একপর্যায়ে জীবিত অবস্থায় টেনে হেঁচড়ে সাঁজোয়া যান থেকে পুলিশ তাকে নিচে ফেলে দেয়। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। সেদিনের লোমহর্ষক ওই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের এমন কাণ্ডে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এদিকে নিহত ওই শিক্ষার্থীর নাম শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাভারে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ তিনি। শহীদ ইয়ামিন সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক টাউন মহল্লার মো. মহিউদ্দিনের ছেলে। তিনি রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন এমআইএসটির ওসমানী হলে। বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ইয়ামিন ছিলেন বড়।
এ বিষয়ে মহিউদ্দিন বলেন, ১৭ জুলাই (বুধবার) সকাল সাড়ে ৯টা বাজে। ইয়ামিন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে সাভারের ব্যাংক টাউনের বাসায় ফেরে। তাদের হল থেকে বের করে দিয়েছে বলে জানায়। মনে অনেক কষ্ট নিয়েই বাসায় ফেরে ইয়ামিন। বাসায় এসে বলল, ‘আমার বন্ধুরা অনেকেই বাড়িতে ফিরতে পারছে না। আমরা স্যারদেরকে বলছিলাম, সবাই (শিক্ষার্থীরা ) বিকেলের দিকে হল ছেড়ে যাই ,তাহলে সবাই গাড়ির টিকিট কাটতে পারবে।’ কিন্তু শিক্ষকরা ওদের কথা শোনেননি। পরে সে আমাকে বলল, ‘খালুর বাড়িতে সাভারের গেন্ডায় তার বন্ধুদের এনে রাখবে।’ কিন্তু সেদিনের যে পরিস্থিতি ছিল, তার বন্ধুরা আসতে পারেনি। বুধবার সারা দিনই ইয়ামিন ঘরের ভেতরেই ছিল। শুধুমাত্র নামাজের সময় ঘরের বাহিরে বের হয়েছে।
এই ঘটনার দিন ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) ভোরে আমি আর ইয়ামিন এক সঙ্গে নামাজ পড়ে আসলাম। পরে সাড়ে ১০টার দিকে ব্যাংকের কাজে বাহিরে যাওয়ার সময় ইয়ামিন বিছানা থেকে দৌড়ে আমার পিছু পিছু এসে বলল- ‘আব্বু মিরপুরে তোমার পরিচিত কোনো হাসপাতাল আছে?’ তখন আমি বললাম, মিরপুরে নাই। কেন কী হইছে? সে বলল- ‘আমার বন্ধুরা আহত হইছে,পরিচিত হাসপাতাল ছাড়া ভর্তি নিচ্ছে না।’ আমি তখন বললাম, টেকনিক্যালে একটি হাসপাতাল আছে। ইয়ামিন তখন রাগ নিয়েই আমাকে বলল- ‘আমি তোমাকে মিরপুরে হসপিটালের কথা বললাম, তুমি আমাকে টেকনিক্যাল দেখাইয়া দিলা। তুমি তোমার কাজে যাও, আমি দেখছি।’ এই বলে রুমে চলে যায় ইয়ামিন।
তিনি বলেন, ওই দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আমি বাসায় ফিরি। তখন সাভারের বিভিন্ন স্থানে গেঞ্জাম চলছে। আমার ড্রাইভার ভেতরের রাস্তা দিয়ে আমাকে বাসায় নিয়ে আসে। আমি বাসায় এসে দেখি ইয়ামিন বিছানাতেই আছে। আমি তখন এসে বললাম, গন্ডগোল তো শুধু ঢাকায় হয় নাই, সাভারেও হচ্ছে। ইয়ামিন তখন আমার সাথে কোনো কথা বলল না । সে সময় আমার কাছে মনে হল, আমি যেহেতু ওর বন্ধুদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করতে পারি নাই তাই রাগ করে আছে। পরে দুপুরে আমি যখন নামাজে যাব, তখন দেখলাম ইয়ামিন গোসল করছে। আমি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার সময় পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ইয়ামিনও আমার সাথে নামাজ পড়ছে। সে দিন আমি রোজা ছিলাম, তবে ইয়ামিনও রোজা থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল।
ওই দিন যেহেতু কোনো কাজ নাই তাই আমি ধীরে-সুস্থে নামাজ পড়ে দুপুর ২টার দিকে বের হলাম। তখন দেখি ওর মা দুই বার ফোন করেছে আমাকে। সেসময় আমি ফোন ব্যাক করলাম, আমাকে বলল ইয়ামিন বাড়িতে নেই। আমি বললাম ও আমাকে বলেছিল ওর বন্ধুদের দেখতে যাবে। এরপরে আমি আবার ইয়ামিনকে ফোন করলাম কিন্তু ইয়ামিন ফোন ধরল না। তখন ওর মাকে ফোনে বললাম, ইয়ামিন আমার ফোনও ধরেনি। ওর ভার্সির্টির বন্ধুরা সবাই মিরপুরে থাকে। রাস্তায় গাড়ি বন্ধ ও কোথায় যাবে তুমি আবার ফোন দিয়ে দেখ। সেসময় আমার মনে একটু খটকা লাগল, ইয়ামিন কোথায় গেল। তারপরও ওর মাকে আমি আল্লাহকে ডাকতে বললাম। হয়তোবা মিছিলে থাকতে পারে তাই ফোন ধরছে না জানালাম।
মহিউদ্দিন বলেন, বিকেল ৩টার দিকে একটি ছেলে ফোন দিয়ে ওর (ইয়ামিন) মাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে বলে। তখন ওর মাকে নিয়ে আমি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে খোঁজ পেলাম না। এরপরে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে যাই, কিন্তু সেখানেও নেই। পরে আমরা নিচে আসি। সে সময় হাসপাতালের একজন নারী চিকিৎসক আমাদেরকে বললেন, আপনারা ইয়ামিনের বাবা-মা। তখন আমার মনে হয়েছিল নরমালের থেকে হয়তো একটু বেশি ইনজুরি হয়েছে। সে সময় কেউ আমাদের কিছু বলছে না। জরুরি বিভাগের পেছনে তালা দেওয়া একটি রুমে ইয়ামিনকে রেখেছিল। অনেক ছাত্রদের দেখলাম কিন্তু কিছু বলল না আমাদের। পরে রুমের তালা খুলে দিয়ে দেখি , স্ট্রেচারে ইয়ামিন শুয়ে আছে ডান দিকে মাথা কাত করা। পরে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর কি হয়েছে, তখন ডাক্তার বলল- ‘ওকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে।’
এ সময় মহিউদ্দিন দুঃখ করে বলেন, ফেসবুকে যেভাবে দেখেছি। ওকে রাস্তায় ফেলা হয়েছে, টানা হেঁচড়া করা হয়েছে। তার কোনো চিহ্ন পাইনি। আমি ওর বাম হাটটা ধরে হাতে নিলাম। তখন দেখলাম ঠান্ডাও হয়নি বা শক্তও হয়নি। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা কী করেছেন। তখন ডাক্তার বললেন- ‘আমরা কোনো কিছু করার সুযোগ পাইনি।’ সেসময় আমরা হাসপাতাল থেকে ছেলেকে নিয়ে আসতে চাইলাম। তখন হাসপাতাল থেকে পুলিশের ঝামেলা ও ছাত্রদের গেঞ্জামের কথা বলছিল। তবে আমি বুঝতে পারছিলাম বাহিরে লাশ নিয়ে মিছিল করার মতো কিছু একটা হচ্ছে। তখন আমি ওর এক বন্ধুর সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত বাসায় নিয়ে আসলাম। পরে ইয়ামিনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হলো না। সেখান থেকে আমার চাচাতো ভাই বলল- ‘পুলিশের ঝামেলা আছে, ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন করতে দেবে না। পরে সেখানে ব্যর্থ হয়ে সাভারের তালবাগ কবরস্থানে চেষ্টা করলাম। সেখানকার (কবরস্থানের ) সভাপতি না করলেন। পরে ব্যাংক টাউন পারিবারিক কবরস্থানেই ইয়ামিনকে কবর দেওয়া হলো।
এদিকে ছেলের মৃত্যুর বিষয়ে মহিউদ্দিন বলেন, আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। আমি কারও কাছে বিচার চাইনি। ছেলের দেহ পোস্টমর্টেম করাইনি। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আমরা যেন ধৈর্য ধরতে পারি। ইয়ামিনের স্বপ্ন নিয়ে তিনি বলেন, ২০০১ সালের ১২ ডিসেম্বরে আমার ছেলের জন্ম। সে সাভারের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছে। রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। সে ওই বিভাগে শিক্ষকের চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিল। এটাই তার স্বপ্ন হয়ে উঠেছিল।
এ সময় মহিউদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ইয়ামিন মারা যাওয়ার পর অনেকেই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা টানার চেষ্টা করেছে, কিন্তু আমি তা হতে দেইনি। ইয়ামিনের গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ছিল। এছাড়াও আমরা কখনো রাজনীতি করিনি। আমাদের পরিবারে কেউ রাজনীতি করতাম না। আমরা ধর্মীয়ভাবে চলা ফেরা করতাম। আমার ছেলেও ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতো। তিনি বলেন, ইয়ামিন বাসায় এলে অনেক চুপচাপ থাকতো। পরিচিত বা অপরিচিতদের সঙ্গে কথা বলার সময় বড়দের মতো কথা বলতো। মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে চাইতো। এ বিষয়গুলো ইয়ামিনকে বেশি মনে করিয়ে দেয়।